বিশ্বকাপ ফাইনালে পৌঁছার উৎসব কীভাবে করতে হয়, ওদের ঠিক জানা নেই। বার বার ফাইনাল খেলে অভ্যস্ত জার্মান, ব্রাজিলীয় কিংবা ইতালিয়ানরা হলে কথা ছিল। উৎসবটা কীভাবে শুরু করতে হয় আর কীভাবে শেষ, ওদের খুব ভালো করেই জানা। কিন্তু ৪১ লাখ মানুষের ছোট্ট এক দেশ ক্রোয়েশিয়া! ফুটবলের উঠুনে নিজ নামে যাদের পদচারণা দুই দশকও ঠিকভাবে পার হয়নি।
এই দলটার জন্য বিশ্বকাপ ফাইনাল নিশ্চয়ই অনেক বড় ব্যাপার। কতটা যে বড়, তা প্রথমটায় নিজেরাও বুঝেনি! উৎসবের মাত্রাটা কেমন হওয়া উচিত, এটা ঠিক করতেও তাই ওদের সময় লাগল অনেকটা। বুকে-বুক মেলানো, হাতে হাত। লুঝনিকির সবুজ জমিনে সবাই মিলে গড়াগড়ি যাওয়া। ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠা। আবেগের রাশটা কোনোভাবেই সামাল দিতে পারল না ক্রোয়েশিয়া। ধাতস্থ হয়ে ঠিকভাবে উৎসব করতে তাই সময় লাগল।
তারপর হাতে হাত ধরে দলটা চলে এল সমর্থকগোষ্ঠীর সামনে। ওরা নাচতে লাগল। দর্শকরা গাইতে লাগলেন। ক্রোয়েট ফুটবলারদের নাচ রূপ নিল বুনো উল্লাসের। হিংস্র কোনো বুনো প্রাণী যেন প্রিয় শিকার ধরে আনন্দ প্রকাশ করতে নেমেছে! অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল এভাবেই।
কিন্তু মাঠ ছাড়ার নাম নেই ক্রোয়েটদের। ফুটবলার আর সমর্থকরা বাঁধন-হারা উল্লাসে মেতে উঠল। অবশেষে অনেক ডাকা-ডাকি করে নিয়ে যেতে হলো তাদের। ১২০ মিনিটের দীর্ঘ লড়াই শেষে ক্লান্ত সৈনিকের দলটা নাচতে নাচতেই মাঠ ছাড়ল। পেছনের খাতায় লিখে গেল একটা নতুন ইতিহাস। রেখে গেল একটা নতুন মাইলফলক।
ইঙ্গিত দিয়ে গেল, বিশ্ব ফুটবলে আসছে নতুন দিন! এবার রাশিয়াতেই প্রমাণ মিলল বদলে যাচ্ছে বিশ্ব ফুটবল। নতুন শক্তির দেখা মিলছে। ফুটবলে ‘অতঃপর দিন শেষে জার্মানদের জয়’ প্রবাদটার মৃত্যু হয়েছে রাশিয়া বিশ্বকাপে। জার্মানি, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, স্পেন, উরুগুয়ে এরপর ইংল্যান্ড। বিশ্ব ফুটবলের মাতব্বর হিসেবে পরিচিত দলগুলো এবার কেমন মলিন হয়ে গেল। জার্মানি হেরে গেল মেক্সিকোর কাছে। হারল দক্ষিণ কোরিয়ার কাছেও।
আর্জেন্টিনা হেরে গেল ক্রোয়েশিয়ার কাছে। বেলজিয়ামের কাছে হারল ব্রাজিল। স্পেন হারল রাশিয়ার কাছে। ইতালি তো বিশ্বকাপটাই খেলতে পারল না। ফুটবলে এই ঘটনাগুলো কী নতুন কোনো ইঙ্গিত দিল! এবার থেকে আর কোনো ‘মোড়লগিরি’ চলবে না ফুটবল মাঠে! আর্জেন্টিনা এবং ইংল্যান্ডের মতো ফেবারিট দলগুলোকে টপকে ফাইনাল নিশ্চিত করে ক্রোয়েশিয়া ফুটবলে ‘মোড়লিপনা’ অনেকটাই শেষ করে দিল। পুরনো শক্তিগুলোর মধ্যে এখনো টিকে আছে ফ্রান্স। রাশিয়া বিশ্বকাপের ফাইনালে ক্রোয়েটরা এই বাধাটা পাড়ি দিতে পারলেই শেষ হবে পুরনো যুগ। নতুন যুগের শুভ সূচনা হোক ক্রোয়েশিয়ার হাত ধরেই। এমন আকাঙ্খা এখন অনেকেরই।
গত কয়েকটা দিন ইংলিশ মিডিয়ায় ক্রোয়েশিয়াকে নিয়ে কম ব্যঙ্গ করা হয়নি। ক্রোয়েশিয়ান কোচ দালিচ কখনো বিশ্বকাপটাই খেলেননি। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে তিনি ছিলেন দর্শকের সারিতে। এই কোচ নিয়ে বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলবে ক্রোয়েটরা! দালিচ বিশ্বকাপই কেবল নয়, খেলেননি ক্রোয়েশিয়ার জাতীয় দলেও। কিন্তু ভালো কোচ হতে হলে ভালো খেলোয়াড় হতে হবে আগে, আছে কি এমন কোনো শর্ত? না, নেই। দালিচ তো তাই প্রমাণ করছেন। প্রফেশনাল ফুটবল খুব বেশিদিন খেলেননি তিনি।
সফলতাও তেমন একটা নেই। কিন্তু কোচ হিসেবে তার সাফল্য যে কোনো কোচের জন্যই ঈর্ষণীয়। দালিচের হাত ধরেই নতুন একটা ইতিহাস লিখতে বদ্ধপরিকর ক্রোয়েশিয়া। সামনে যে ফরাসিরা ওত পেতে অপেক্ষায় আছে, তাতে কোনো ভয় নেই ক্রোয়েটদের। টানা তিনটা ম্যাচ ১২০ মিনিট করে খেলল ক্রোয়েশিয়া।
তেত্রিশের লুকা মডরিচ, বত্রিশের মারিও মানজুকিচ, ত্রিশের রাকিটিচরা যে শক্তি ও সাহস দেখিয়েছেন বিশ্বকাপ জুড়ে, ফরাসি বিপ্লবের ঢেউ তাদের থামাতে পারবে কি না বলা কঠিন। এমন সাহস, এমন দৃঢ়তা দেখিয়েছিল স্পেন। আট বছর আগে স্প্যানিশ আর্মাডার সামনে মুখ থুবড়ে পড়েছিল জার্মানি। হার স্বীকার করেছিল নেদারল্যান্ডস। ঠিক একইভাবে এবারেও ক্রোয়েটদের কাছে হার মানছে বিশ্ব ফুটবলের রাঘববোয়ালরা। ফাইনালটা জিতলেই কেবল ‘বৃত্তপূরণ’ হবে ক্রোয়েশিয়ার।
একই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মতো ফুটবলের মহাশক্তিধরদের হারিয়ে বিশ্বকাপ জেতার পর কেউ আর ক্রোয়েশিয়ার দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে বলতে পারবে না, তোমরা বিশ্বকাপটা হঠাৎ করেই কুড়িয়ে পেয়েছ! বিশ্ব ফুটবলে পালা বদলের ডাক দিয়ে গেল ক্রোয়েশিয়া। এবার হয়ত আরও অনেক দলই বিশ্বকাপের দাবিদার হয়ে উঠবে। পরবর্তী প্রজন্ম হয়ত দেখবে, ফুটবলে কোনো ফেবারিটই নেই। ক্রোয়েশিয়া চ্যাম্পিয়ন হলে পরের আসরগুলোতে কেউ আর ফেবারিট দল নিয়ে মাতামাতি করবে না বিশ্বকাপের আগেই। তখন বিশ্বকাপের ৩২টি (হয়ত ৪৮টি!) দলই থাকবে ফেবারিট।